এনআরবিসি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী। বেনামী শেয়ারহোল্ডার ও বহিরাগতদের সঙ্গে জোট করে ব্যাংক থেকে আত্মসাৎ করেন প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। ঋণ কেলেঙ্কারীসহ নজিরবিহীন বিভিন্ন দুর্নীতি ও জালিয়াতির দায়ে অপসারিত হন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে। দন্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ায় আবার ব্যাংকের পর্ষদে ফিরতে তোড়জোর শুরু করেছেন। সঙ্গে নিয়েছেন আগের দুর্নীতির সঙ্গী বেনামী শেয়ারহোল্ডারদের। বেনামী শেয়ারহোল্ডারা হলেন সরোয়ার জামান চৌধুরী, কামরুন নাহার সাখী, কানিজ ফাতেমা রাশেদ , তুষার ইকবাল, ফিরোজ হায়দার খান ও এনায়েত হোসেন, প্রমুখ। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত তাদের সঙ্ঘবদ্ধ দুর্নীতির কারণে বন্ধ হতে বসেছিল এনআরবিসি ব্যাংক। তৎকালীন চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলীসহ বোর্ডের ৬ পরিচালককে অপসারণ করে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
সূত্র জানায়, ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার সময় নিজের আধিপত্য স্থায়ী করার লক্ষ্যে নিজের পরিবারের সদস্য এবং নিজস্ব বলয়ের ব্যবসায়ীদের নামে বিপুল পরিমান শেয়ার কেনেন। নিজের এবং নিজের আত্মীয়-স্বজন এবং পরিবারের ১৬ জন সদস্যদের নামে শেয়ার কেনেন প্রিমিয়ামের টাকায়। ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলীর পরিবারের সদস্যরা হলেন, ডক্টর শাহানারা বেগম আলী, ফারুক আলী, ফেরদৌসী বেগম, মোঃ আশরাফ আলী, ফাহাদ মাদানী, শামিম আলী, শওকত আলী।
ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য আনুষাঙ্গিক খরচের নাম করে অন্য উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করেন ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী। এছাড়া প্রিমিয়ামের টাকায় এনআরবিসি ব্যাংকের উদ্যোক্তা হয়েছেন গোলাম রব্বানী, সোনাওর আলী, ফাহাদ মাদানি,ফারুক আলী, শামীম আলী, আশরাফ আলী, সাখাওয়াত আলী, ইজহারুল ইসলাম হাওলাদার প্রমুখ। এছাড়া অন্তত ৫/৬ জন বাংলাদেশে বসবাসরত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে প্রবাসী বাংলাদেশীদের নামে শেয়ার কেনেন। এসব বেনামী শেয়ারহোল্ডারদের পরবর্তীতে ব্যাংকের পরিচালক করা হয় এবং ওই পরিচালকরা কখনো দেশে না আসলেও তাদেরকে পর্ষদের সভায় উপস্থিত দেখানো হয়। বেনামী শেয়ারহোল্ডারদের প্রকৃত সুবিধাভোগী বাংলাদেশে বসবাসকারী ব্যবসায়ীরা পর্ষদ সভায় অংশগ্রহণ করে এবং জাল স্বাক্ষর প্রদান করে।
তৎকালীন চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলীর প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতায় বেনামী শেয়ারহোল্ডার হওয়ার সুযোগ পান অন্য ব্যাংকের সাবেক এক পরিচালক। ব্যাংকের উদ্যোক্তা ও পরিচালক কামরুন নাহার সাখীর শেয়ারের প্রকৃত সুবিধাভোগী অন্য ব্যাংকের সাবেক এক চেয়ারম্যান । ওই চেয়ারম্যান নিয়মিত এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় অংশ নিতেন এবং নিজের নাম ঋণ অনুমোদন করে নিয়েছেন। আরেক সাবেক পরিচালক পরিচালক আমির হোসেনের শেয়ারের প্রকৃত সুবিধাভোগী রতনপুর স্টিলের (আরএসআরএম) গ্রুপের কর্ণধার মাকসুদুর রহমান। এছাড়া এনায়েত হোসেনের শেয়ারের প্রকৃত মালিক খান মুজিবুর রহমান, আমির হোসেনের শেয়ারের প্রকৃত মালিকও মাকসুুদুর রহমান এবং সরোয়ান জামান চৌধুরীর নামে দেখানো শেয়ারের প্রকৃত মালিক মামুন মুছা।
বেনামী শেয়ারহোল্ডাদের নিয়ে গঠিত পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংক অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। প্রায় ৭০৮ কোটি টাকা বেনামে অনুমোদন করিয়ে নিজেরা আত্মসাৎ করেন কয়েকজন পরিচালক। ওই সব ঋণ এখনো ব্যাংকের গলার কাটা। নিয়মিত পরিদর্শনে এনআরবিসি ব্যাংকে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় ২০১৭ সালে বিশেষ পরিদর্শন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের এফআইসিএসডি। বিশেষ পরিদর্শনে বেনামী শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালক, ঋণের নামে অর্থ আত্মসাৎ, অনুপস্থিত পরিচালকদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে উপস্থিত দেখানো, পর্ষদের সভায় বহিরাগতদের নিয়মিত অংশগ্রহণ ইত্যাদির প্রমাণ পায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের কারছে চেয়ারম্যান, এমডি ও পরিচালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগে (বিআরপিডি) সুপারিশ পাঠায় এফআইসিএসডি। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে ২০১৭ সালের ২০ মার্চ চেয়ারম্যান ও ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী ও এমডি দেওয়ান মুজিবুর রহমানের কাছে কারণ দর্শনোর নোটিশ দেয়। এছাড়া তাদেরকে ব্যক্তিগত শুনানী করা হয়। অনুপস্থিত পরিচালকদের স্বাক্ষর জাল করে পরিচালনা পর্ষদের সভা, ইসি কমিটিসহ অন্য সভায় উপস্থিত দেখানো এবং তা বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরণ করে প্রতারণা এবং জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়ায় ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর তৎকালীন এমডি দেওয়ান মুজিবুর রহমানকে অপসারণ করা হয়।
এরপর ১০ ডিসেম্বর চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলীসত ৬ পরিচালকে সরিয়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়। ২০২০ সালের ২১ জুন ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলীকে ২ বছরের জন্য ব্যাংকখাতে নিষিদ্ধ করে আদেশ জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই আদেশে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন ও ব্যক্তি শুনানীতে প্রমাণিত হয় যে, ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী অনুপস্থিত পরিচালকদের জাল স্বাক্ষর প্রদানে সহায়তা করে গুরুতর জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ, পরিচালনা পর্ষদের সভায় বহিরাগতদের উপস্থিত থাকার সুযোগ প্রদান, নীতিমালা লঙ্ঘণ করে বিকল্প পরিচালক নিয়োগ, ঋণ খেলাপিদের পরিচালক নিয়োগ, বাংলাদেশে বসবাসরত ব্যবসায়ীদের বেনামে শেয়ার ধারণের সুযোগ প্রদান, পরিচালকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ঋণ অনুমোদন, একক ঋণগ্রহণ নীতিমালা লঙ্ঘন, বেনামী প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অসত্য তথ্য প্রদান করে ব্যাংক কোম্পানি আইন লঙ্ঘণ এবং আমানতকারীদের স্বার্থ ক্ষুন্ন করেছেন।
বেনামী শেয়ারহোল্ডারদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাহ উল হক বলেন, এনআরবিসি ব্যাংকের বেনামী শেয়ারহোল্ডারদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম চলমান আছে।
সাবেক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলীর সাথে কথা বলার জন্য চেষ্টা করলে জানা যায় তিনি এখন বিদেশে আছেন।
মন্তব্য করুন