মাগুরা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে রাজস্ব খাতের আওতায় ১১-১৭ গ্রেডভুক্ত মোট ৬টি পদের বিপরীতে ৭১ জন জনবল নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। সিভিল সার্জন অফিসের দুইজন কর্মকর্তা ও কর্মচারি এই ঘটনার নেপথ্য নায়ক বলে গুঞ্জন চলছে। তারা সিভিল সার্জন ও নিয়োগ কমিটির অন্যান্য সদস্যদের ম্যানেজ করে চাকুরী দেবার শর্তে কমপক্ষে ৫০ জন প্রার্থীর কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুস নিয়েছেন মর্মে অভিযোগ উঠেছে।
একাধিক সুত্রে জানাগেছে, মাগুরা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে রাজস্ব খাতের আওতায় ১১-১৭ গ্রেডভুক্ত মোট ৬টি পদের বিপরীতে ৭১ জন জনবল নিয়োগের জন্যে গত ২৭ ডিসেন্বর ২০২৩ নিযোগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
পদগুলো হলো: পরিসংখ্যানবিদ-৪ জন,কোল্ড চেইন টেকনিশিয়ান-১ জন,অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষারক-৩ জন,স্টোর কিপার-৫ জন,স্বাস্থ্য সহকারী-৫৫ জন,গাড়ি চালক-৩ জন। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর মাগুরা জেলার প্রায় ৫০ হাজার প্রার্থী আবেদন করে। তাদের মধ্য থেকে লিখিত পরীক্ষার জন্য মোট ৮ হাজার প্রার্থীকে পত্র দেওয়া হয়। লিখিত পরীক্ষা গ্রহনের পর খাতা মুল্যায়ণ অন্তে গাড়ি চালক পদে ১৬ জন,স্বাস্থ্য সহকারী পদে ১২১ জন, কোল্ড চেইন টেকনিশিয়ান পদে মাত্র ১ জন,স্টোর কিপার পদে ১৯ জন,পরিসংখ্যনবিদ পদে ২২ জনঅফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষারক পদে ১৮ জনকে পাশ করানো হয়। গতকাল এদের ভাইভা পরীক্ষা নেওয়ার সময় প্রক্সি পরীক্ষা দিতে এসে ৪ জন চাকরি ভুয়া প্রার্থী আটক হয়েছে। রোববার সন্ধ্যায় তাদেরকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
আটক ৪ পরীক্ষার্থী হলো: মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের এসকে নুরুজ্জামানের ছেলে এসকে মনিরুজ্জামান, একই উপজেলার মন্ডলগাতি গ্রামের আলাউদ্দিন মন্ডলের ছেলে শরিফুল ইসলাম, নাগড়া গ্রামের জামাল মুন্সির ছেলে সজিব হোসাইন এবং সদর উপজেলার আমুড়িয়া গ্রামের ওয়াহাব আলির ছেলে মিরাজ হোসেন। তারা মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে প্রক্সি পরীক্ষা দিতে এসেছিল বলে জানাগেছে।
মাগুরা সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মাগুরা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে রাজস্ব খাতের আওতায় ১১-১৭ গ্রেডভুক্ত মোট ৬টি পদের বিপরীতে ৭১ জন নিয়োগের জন্যে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে রোববার মাগুরা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে আহবান জানানো হয়। সেখানে মৌখিক পরীক্ষা চলাকালে অভিযুক্ত ৪ প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষার খাতা সমন্বয় করতে গেলে সামঞ্জস্যতা না পাওয়ায় তাদেরকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
অভিযুক্তরা স্বাস্থ্য সহকারী পদের জন্যে আবেদন করলেও শুক্রবারে অনুষ্ঠিত লিখিত পরীক্ষায় তারা প্রক্সি পরীক্ষার্থী নিয়োগ করে। একেক জনের বিপরীতে ২ লাখ টাকা নিয়ে প্রক্সি পরীক্ষার্থীরা লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। লিখিত পরীক্ষা শেষে শনিবার রাতে প্রকাশিত ফলাফলে উত্তীর্ণ প্রার্থী হিসেবে অভিযুক্ত প্রার্থীদের নাম প্রকাশ হলে তারা রোববারের মৌখিক পরীক্ষায় সশরীরে অংশ নিতে গেলে আটক হয়।
তবে অভিযুক্ত চাকরিপ্রার্থীদের পক্ষে কারা লিখিত পরীক্ষায় কারা অংশ নিয়েছে সেটি সম্পর্কে সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়নি।
এ বিষয়ে মাগুরা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) পিয়ার উদ্দিন বলেন, সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রক্সি পরীক্ষার্থী নিয়োগের সঙ্গে জড়িত থাকায় ৪ জনকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে। এ বিষয়ে মামলা দায়ের হয়েছে। এদেরকে রিমান্ডে এনে পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদ করলেই বেরিয়ে আসবে যে, তাদেরকে কারা ভাড়া করে এনেছিল।
এদিকে নানা মাধ্যমে খোঁজ খবর নিয়ে জানাগেছে. মাগুরা সিভিল সার্জন অফিসে জনবল নিয়োগ করার জন্য ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি নিয়োগ কমিটি গঠন করা হয়।
এই কমিটির সভাপতি হলেন, খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা: মো: মুনজুরুল মুরশিদ,সদস্য সচিব- মাগুরার সিভিল সার্জন ডা: শামীম কবীর,স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মানব সম্পদ বিভাগ (২) এর সিনিয়র সহকারী সচিব সুজিত দেব নাথ সদস্য, মাগুরা জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (আইসিটি) মো: রোকনুজ্জামান সদস্য।
অভিযোগ উঠেছে যে, মাগুরা সিভিল সার্জন অফিসে একজন মেডিকেল অফিসার,একজন সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা অফিসার, একজন জুনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা অফিসারসহ আরো ৬ জন কর্মচারি থাকলেও ২ জন প্রভাবশালী কর্মকর্তা ও কর্মচারি নিয়োগ পক্রিয়ার সমস্ত কলকাঠি নাড়ছেন। তারা ২ জন সিভিল সার্জন ডা: শামীম কবীরের অত্যন্ত আস্থাভাজন হওয়ায় ফাইলপত্র সংরক্ষন ও নিয়োগ সংক্রান্ত ফাইল ওয়ার্কের জন্য তাদেরকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। সিভিল সার্জন অফিসের প্রধান সহকারী মো: ওলিয়ার রহমান হলেও তাকে কোনঠাসা করে রেখে নিয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় দাপ্তরিক কাজ করানো হচ্ছে এই ২ জনকে দিয়ে। তারা হলেন- ক্যাশিয়ার আবুল কালাম আজাদ ও জুনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা অফিসার মো: হায়াত হোসেন। তাদের বিরুদ্ধে লিখিত পরীক্ষার খাতার মার্ক টেম্পারিং করার জোরাল অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে যে, তাদের সাথে যে সব প্রার্থীর চুক্তি হয়েছে তাদের লিখিত পরীক্ষার খাতার মার্ক টেম্পারিং করে নম্বর বদলে কৃতকার্য করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে যে, এই ২ কর্মকর্তা ও কর্মচারি সিভিল সার্জন ডা: শামীম কবীরের ডানহস্ত হয়ে নিয়োগ বাণিজ্যে লিপ্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা দালাল নিয়োগ করে তাদের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করছে। তারা স্বাস্থ্য সহকারী পদের জন্য ১২ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা,পরিসংখ্যনবিদ পদের জন্য ২০ লক্ষ টাকা, ড্রাইভার পদের জন্য ৮ থেকে ১০ লক্ষ টাকা, অফিস সহকারী পদের জন্য ১০ থেকে ১৪ লক্ষ টাকা এবং স্টোর কিপার পদের জন্য ২০ লক্ষ টাকা দাবী করছে। যে সব প্রার্থী তাদের দাবী মত টাকা দিতে রাজী হয়েছে তাদের কাছ থেকে অগ্রিম অর্ধেক টাকা গ্রহন করা হয়েছে। বাকি টাকা নিয়োগপত্র পাবার পর নেওয়া হবে বলে চুক্তি করা হয়েছে। একাধিক সুত্রের দাবী, নিয়োগ কমিটির সভাপতি,সদস্য সচিব ও অন্যান্য সদস্যদের নামে এই টাকা নেওয়া হয়েছে। এখন ভাইভা বোর্ডে প্রক্সি পরীক্ষার্থী এনে কৃতকার্য করানোর চেষ্টা চলছে।
অপর দিকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় একজন প্রার্থীও লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেনি যা যথেষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। প্রতিবন্দ্বী কোটারও একই অবস্থা। এছাড়া কোল্ড চেইন টেকনিশিয়ান পদে মাত্র একজন প্রার্থীকে লিখিত পরীক্ষায় পাশ করানো হয়েছে। ফলে তার চাকুরী নিশ্চিত হয়েগেছে। ভাইভা পরীক্ষায় মাত্র একজন প্রার্থী থাকেলে সেই পদের নিয়োগ অবশ্যই বাতিল হওয়ার যোগ্য বলে অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন। কোল্ড চেইন টেকনিশিয়ান পদে কেন মাত্র একজন পরীক্ষার্থীকেই পাশ করানো হলো তার কোন জবাব মেলেনি।
সুত্রটি আরো জানায়, যে সব প্রার্থী চাহিদামত টাকা দিতে পেরেছে বা চুক্তিবদ্ধ হয়েছে তাদের একটা গোপন তালিকা করে রাখা হয়েছে। এই তালিকাতেই নিয়োগ কমিটির সদস্যরা স্বাক্ষর করবেন বলে চুক্তিবদ্ধ প্রার্থীদের আস্বস্থ করা হচ্ছে। ৭১ জন কর্মচারি নিয়োগের এই বাণিজ্যে সিন্ডিকেটের ২ সদস্য ইতিমধ্যেই ১০/১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে সুত্রগুলো দাবী করেছে। এই নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে ক্যাশিয়ার আবুল কালাম আজাদ ও জুনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা অফিসার মো: হায়াত হোসেনকে বাদ না দিলে গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে বলে আশংকা করছেন মাগুরা জেলাবাসী।
এ বিষয়ে নিয়োগ কমিটির সভাপতি খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা: মো: মনজুরুল মুরশিদ ও সদস্য সচিব মাগুরা সিভিল সার্জন ডা: শামীম কবীরের সাথে কথা বললে তারা জানান,এখনো কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ভাইভা চলছে। আমরা শতভাগ স্বচ্ছতার সাথেই নিয়োগ প্রক্রিয়া চালাচ্ছি। অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দানের যে কথা বলা হচ্ছে তা পুরোটাই গুজব। কোন কর্মচারি বা কর্মকর্তা অবৈধ লেনদেনে জড়িত হলে তাদের কঠোর শাস্তি পেতে হবে।
লিখিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য প্রার্থীরা এই নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করে নতুন নিয়োগ কমিটি গঠনের মাধ্যমে স্বচ্ছতার সাথে নিয়োগ দানের জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যসচিব, ও স্বাস্থ্যের মহাপরিচালকের প্রতি আবেদন জানিয়েছে।
মন্তব্য করুন