প্রতারণার মাধ্যমে জাহাজের মালিকানা দলিল, নৌযান রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, জাহাজের নাম ও মালিকানা পরিবর্তন সনদ তৈরী করে জাহাজ বিক্রি ও বিক্রয় দলিল সম্পাদনার অপরাধে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের সদরঘাটের জাহাজ জরিপকারক ও অভ্যন্তরীণ নৌযান রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. সিরাজুল ইসলাম, রমনার ফারজানা আমান এবং বাগেরহাটের তরুণ আকনের বিরুদ্ধে খুলনা সদর থানায় মামলা দায়ের করেছেন জাহাজের মালিক মো. শামীম হোসেন।
শামীম হোসেন ইতোমধ্যে মামলার পাশাপাশি নৌ-পরিবহণ অধিদপ্তর, সদরঘাট ঢাকার প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক, বৈদ্যের বাজার নৌ-পুলিশ, বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং খুলনা অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ মালিক গ্রুপকে লিখিতভাবে বিষয়টি জানিয়েছেন।
এ ঘটনায় নৌ পরিবহন অধিদপ্তর একটি বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করলেও আজ অব্দি অভিযুক্ত আসামী জাহাজ জরিপকারক প্রকৌশলী মো: সিরাজুল ইসলামকে চাকুরী থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়নি। চাকুরী শৃংক্ষলা সরকারী চাকুরী বিধি অনুযায়ী কোন সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারির বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা হলে এবং তিনি আদালত কর্র্তক জামিন গ্রহন করলেও তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার বিধান রয়েছে। কিন্তু জরিপকারক প্রকৌশলী মো: সিরাজুল ইসলাম এর ক্ষেত্রে এ বিধান অকার্যকর রয়েছে। ফলে তিনি আদালত কর্তৃক জামিন নিয়েও চাকুরীতে বহাল রয়েছেন।
জানা গেছে, গত ১৮ ডিসেম্বর সকালে নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাটে তরুণ আকন এবং ফারজানা আমান লোকজন নিয়ে ‘এম.ভি আর কে ডি এস-১’ জাহাজের মালিকানা দাবি করেন এবং এর মালামাল নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করেন। জাহাজে থাকা নাবিকরা বিষয়টি তখন এর মালিক শামীম হোসেনকে জানায়। পরবর্তীতে শামীম হোসেন সদর ঘাটের প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক এবং অভ্যন্তরীণ নৌযান রেজিস্ট্রার, অভ্যন্তরীণ নৌযান সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন অফিস থেকে কাগজপত্র সংগ্রহ করেন।
সেখান থেকে তিনি জানতে পারেন তার আপন বড় ভাইয়ের ছেলে তরুণ আকন এবং রমনা এলাকার আমানউল্লাহ চৌধুরীর মেয়ে ফারজানা আমান এবং সদরঘাটের জাহাজ জরিপকারক ও অভ্যন্তরীণ নৌযান রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. সিরাজুল ইসলাম পরস্পর যোগসাজশে প্রতারণার মাধ্যমে মালিকানা দলিল, নৌযান রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, জাহাজের নাম ও মালিকানা পরিবর্তন সনদ এবং সার্ভে সনদ তৈরি করেছে। এইসব কাজ করার জন্য তরুণ আকন তার চাচা শামীম হোসেনের নাম ব্যবহার করে এবং ভুয়া নম্বর দিয়ে অনলাইনে জিডিও করেন।
মামলার বাদী শামীম হোসেন জানান, আমার অজান্তে ভাইপো তরুণ আকন ৮ আগস্ট আমি তার কাছে সাড়ে ৪ কোটি টাকার বিনিময়ে জাহাজ বিক্রি করেছি মর্মে নোটারি পাবলিক তৈরি করে। ‘এম.ভি আর কে ডি এস-১’ নামের জাহাজটি সার্ভে রেজিস্ট্রেশন অনুযায়ী ৫৯৩ মেট্রিক টন ক্ষমতাসম্পন্ন। এর দৈর্ঘ্য ৫৩ দশমিক ৩৬ মিটার, প্রস্থ ১০ দশমিক ৩৭ মিটার এবং গভীরতা ৪ দশমিক ৫৮ মিটার। এরপর সদরঘাটের সার্ভে অফিসে সে আমার অনুপস্থিতিতে মালিকানা পরিবর্তন করে।
এ ঘটনার পর ১০ ডিসেম্বর তরুণ আকন রমনা এলাকার ফারজানা আমানের কাছে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকার বিনিময়ে জাহাজটি বিক্রি করে দেয়। প্রথমত জাহাজ বিকিকিনির সময় বিক্রেতাকে সশরীরে উপস্থিত থাকার কথা এবং সার্ভেয়ার জাহাজটি সার্ভে করার নিয়ম থাকলেও দুইবার চারমাসের ব্যবধানে জাহাজ বিক্রি হলেও কোনো সার্ভে হয়নি। প্রথমবার আমি অসুস্থ এবং মামলার আসামি বলে আসতে না পারার অজুহাতে তরুণ সার্ভে অফিস ম্যানেজ করে মালিকানা পরিবর্তন করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তরুণ চারমাসে জাহাজটি দুইবার বিকিকিনি করেছে। কিন্তু এতে কাগজপত্রে সে জাহাজের ভিন্ন নাম দেখালেও এখনও জাহাজটি আগের নামেই আছে। এ ছাড়া ১৯ নভেম্বর আমার জাহাজ সব কাগজপত্র দেখিয়ে কলকাতা গিয়েছিল। সেখানেও কোনো বাধা হয়নি। তিনজন মিলেই আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
এ বিষয়ে খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামাল হোসেন খান বলেন, ঢাকার সদরঘাটের সার্ভেয়ার, এক নারী ব্যবসায়ী এবং খুলনার একজনসহ তিনজনের নামে প্রতারণা ও জালিয়াতি মামলা হয়েছে। এখনও কোনো আসামি আটক হয়নি। তিনি বলেন, প্রতারণার উদ্দেশ্যে জাহাজের মূল মালিকের নাম ব্যবহার করে ভিন্ন নম্বর দিয়ে অনলাইনে জিডি করা হয়েছিল বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য-প্রমাণ পেয়েছি।
এদিকে খুলনার জাহাজ ব্যবসায়ীরা জানান, এমন অভিনব জালিয়াতের মাধ্যমে জাহাজের মালিকানা পরিবর্তন করাটা রীতিমতো বিস্ময়কর। এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে তারা বলেন, সার্ভেয়ার অফিসের সহযোগিতা ছাড়া এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এই বিষয়টি তদন্ত করা প্রয়োজন। মূল প্রতারকদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা উচিত।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সদর ঘাটের জাহাজ জরিপকারক ও নৌ-প্রকৌশলী মো: সিরাজুল ইসলামের সাথে কথা বলার জন্য কয়েকবার তার সেল ফোনে কল দিলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন