নিজস্ব প্রতিবেদক
৬ জুলাই ২০২৪, ১১:৪১ পূর্বাহ্ন
অনলাইন সংস্করণ

পশু পালনে নারীদের ভূমিকা ও আর্থিক বঞ্চনা প্রসংগে -সৈয়দা রাশিদা বারী

-সৈয়দা রাশিদা বারী লেখক: সাংবাদিক, কবি ও গীতিকার

প্রতিবছর কোরবানির সময়ে রমরমা ব্যবসা হয় সাধারণত বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার সবগুলো পশুর হাটে। দেশের অর্থ খাতের উন্নয়নে অন্তত পুরুষের পাশে নারীরও একটা ভূমিকা থাকতে পারে। আর নিশ্চয়ই সেটা থাকলে মন্দ হয় না।

সামান্য তদন্তে দেখছি যে, ১০৬ বছর বয়সী পশু হাটেরও হদিস আছে। কিন্তু কোন হাটের কোথাও নারীর কোন স্থান নেই। আমি এখন সেই রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে বড় এবং একমাত্র স্থায়ী পশুর হাটের সামান্য বিবরণ দিচ্ছি। এই হাটের প্রতিষ্ঠাতা এবং উদ্বোধক জমিদারের নায়েব বিদ্যা অনুরাগী ও দানশীল ব্যক্তিত্ব মুন্সি লাল মিয়া। তিনি ১৯১৭ সালে এখানে প্রথম পশুর হাট বসিয়ে ছিলেন। সেই সময়ে জমিদারদের মধ্যে হিন্দু এসেছিল। তাই হিন্দুর প্রভাব বেশি থাকায় গো হত্যা নিষেধ ছিলো। আমাদের কুষ্টিয়ার বিখ্যাত উপন্যাসিক বিষাদ সিন্ধুর লেখক মীর মোশাররফ হোসেন তার গো জীবন রচনায় বুঝতে পারা যায়, তিনিও গো হত্যার বিরুদ্ধে ছিলেন। তাই হুজুররা আবার তার পিছনে লেগে ছিলো। যার ফলে তার কবরটাই বাস্তভিটাতে দিতে দেয়নি বা হয়নি।

হ্যাঁ ১৯৩১ সালে মিরপুর মাজার রোড ৩১.৯০ একর জমি ওয়াকফ করেন লাল মিয়া জমিদারের একজন নায়েব। যদিও জমিটা ছিল জমিদারের। আসলে জমিদারি প্রথা ভাঙার আগে এবং পরে প্রভাব ছুটে গেলে যা হয়। তাই এ ধরনের বেশ কিছু কাজ হয়েছিল নানা কারণে। ঐ জমি ওয়াকফ এর শর্ত ছিল প্রজন্মরা এই জমির ইনকাম খেতে পারবে কিন্তু বিক্রি করতে পারবেনা। পিছনে যাই থাক তবে এটা ছিল সুন্দর একটি উদ্যোগ। এই ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করেন ১৯৪১ সালে। তার দানকৃত জমিতে আছে তার মাজার, মসজিদ, ঢাকা মানিকগঞ্জ মহাসড়ক, বাস স্টেশন এবং তার প্রতিষ্ঠিত দুধ মেহের দাতব্য চিকিৎসালয়, এই বৃহৎ পশু হাট ইত্যাদি।

তখন এখান থেকে প্রতি পশু বাবদ ৪ আনা খাজনা নিয়ে মানুষের সেবায় ওই সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা হতো। হাট বসত সপ্তাহে ১দিন। আর এই হাটের রাজস্ব আয় সরকারিভাবে শুরু হয় স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে। সেই ১৯৩১ সাল থেকে ইজারাদাররা ইজারা নিয়ে এই হাট পরিচালিত রেখেছে। এখানে গরু রাখার স্থানে, গরু বাধার বাঁশের আড় বানানো রয়েছে। সব সময়ই তা মেরামত করা হয়। তবে কোরবানি ঈদের সামনে বাড়ানো হয়। গরু রাখতে ব্যাপারীদের গরু প্রতি বর্তমান ৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। বলা যায় এই হাটে কোরবানি ছাড়াও গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ সমানে সবসময় বিক্রি হয়। অন্তত নিম্নতম ৪০/৫০ টি তো অবশ্যই হয়। পশুর মধ্যে গরুর একটা ভালো ব্যবসা এই কুরবানির ঈদকে ঘিরে হয়।

তখন দুই এক সপ্তাহ ধরে প্রায় প্রতিদিন একনাগাড়ে অসংখ্য পশু বলা চলে হাজারে হাজার বিক্রি বা সেল হয়। নারী-পুরুষের হাতে পালা পশু ছাড়াও এখানে আসে টাঙ্গাইলের সরকার ক্যাটেল ফার্ম থেকে ইন্ডিয়ান বলদ। তবে ভারত ও মিয়ানমার থেকে গরু আমদানি বন্ধ করা রয়েছে। তারপরও মাঝেমধ্যে দুই চারটা চোখে বাধছে।

বাংলাদেশের সমস্ত পশুর হাটে বর্তমান বাজার আকার ভেদে গরুর বিক্রয় হার গড়ে ৫৫ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত। হাট গুলোতে বর্তমানে নিরাপত্তা ভালো দেওয়া হয়। পুলিশের সার্বিক সহযোগিতা সর্বক্ষণিক থাকে। প্রায় হাটে সেট করা হয় জাল নোট ধরার মানে ভুয়া টাকা সনাক্ত করার মেশিন।

এই পশু হাটকে কেন্দ্র করে গরুর খাবার যেমন ডাল, ছোলা, ভুট্টা, গম, ভুষি, খড়, ছাল, ঘাস ইত্যাদি বিক্রয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে। খুবই রমরমা ব্যবসা চলে। এবং মানুষের থাকা খাওয়ার আবাসিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। প্রচুর পরিমাণে টিউবওয়েল ও সাপ্লাই পানি উঠাবার ডিপ মেশিনের পানি সরবরাহর সুব্যবস্থা রয়েছে। এগুলো যারা ইজারা নেয়, হাট ডাকে, তারাই অতি দায়িত্বের সাথে পরিচালনা করে। কিন্তু দুঃখজনক যে, সবই পুরুষের জন্য এবং সমস্ত ব্যবসায় এখানে পুরুষেরা করছে।

সবারই জানা যে, আমাদের দেশ এখন সবকিছুতে বেশ এগিয়ে চলেছে। নারী শ্রমিকের হার আগে তুলনায় বেড়ে চলেছে। তারা আর এখন কেউ ঘরে বসে নেই। নারী-পুরুষ একযোগে কাজ করছে দেশের উন্নয়নে। রাস্তায় মাটিকাটা, বালি টানা, খোয়া ভাঙ্গা, ইট ধোয়া, কালভার্ট বিল্ডিং এর প্লাস্টার করা, মাঠের নানা ফসলের কাজ করা থেকে কোথাও বাদ নাই যে নারী শ্রমিক নাই। নারী শাসন শোষণ নির্যাতনের হার কমাতে এদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ এবং উৎসাহে নারী শ্রমিকের স্থান সব সেক্টরে আছে ইনশাল্লাহ।

শুধু এই সেকশন অর্থাৎ কোরবানীর পশু ব্যবসা খাত বাদে। কিন্তু নারীরাই তো পশু খামার গুলোতে পশু লালন পালনে বেশি শ্রম দিচ্ছেন। কেবল এই সেল কেন্দ্র পশু বাজার বাদে। এখানেই নারী তার লালন পালনকৃত পশু সেল করতে, অর্থ সঞ্চয় উন্নয়নে মার খেয়ে যাচ্ছেন বলে নারী পশুখামারি ব্যাবসিক সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানতে পারি।

নারী তার পশু পালনের পারিশ্রমিক বুঝে নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন এই একটা বিষয়ে। যে তার পশুটি সে নিজে উপস্থিতিতে সেল করতে পারছেন না যখনই সে কোন পুরুষের হাতে তার লালন পালনকৃত পশুটি দিচ্ছে বিক্রি করার জন্য। তখনই তার পশু বিক্রির লভ্যাংশর পুরা অর্থ বুঝে উঠাতে পারছেন না। পিঁপড়ে খেয়ে নিচ্ছে বলে তারা জানান।

পশুর যাবতীয় খাবার এর খরচ নারীরা বহন করে, এছাড়া সংসারের অন্যান্য কাজের পাশাপশি পশু পালনে তারা সময়ও ব্যয় করেন। তাদের অভিযোগ, স্বামী ছাড়াও স্বামী না থাকলে অন্যান্য পুরুষ আত্নীয়ের কাছে দিলেও তারা বিক্রিত অর্থ নারীদের দেয় না। তাই দেশের আর্থÑসামাজিক উন্নয়নের স্বার্থে কোরবানীর পশু পালন এবং সেল বাবদ প্রাপ্য অর্থ পেলে নারীরাও পুরুষের পাশাপাশি আরও বেশি স্বাবলম্বী হতে পারবেন।

পশু পালনকারী নারীদের বক্তব্য হলো, তাদের পালিত পশুটি বিক্রির সময় অন্যের হাতে দিলে তখন পশুটি ঠিকমতো খায় না এবং গোসলও করতে চায়না। এভাবে তার পশুটি গায়ে গতরে মাংসে শুকিয়ে যাচ্ছে। পশুর তারুণ্য হারাচ্ছে। নিঝিম ও দুর্বল হয়ে থাকছে। ফলে আশা অনুপাত মূল্যে সঠিক দামে তার কষ্টের লালন পালন করা পশুটি বিক্রয় হচ্ছে না।

নারীরা তাদের লালন পালন করা পশু নিজের দায়িত্বে থেকে সেল করার সুযোগ যাতে পান সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে তারা মনে করেন । তাহলে তারা সামনে আরো বেশি পশুপালনে উৎসাহ পাবেন, উদ্যোগী হবেন, সার্ভিস ভালো দেবেন। এতে দেশ উন্নয়নে এগিয়ে যাবে। আমি আমার দেশের স্বার্থে এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষর দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম।

কেন তৃণমূল পর্যায়ের নারীরা দেশ এবং সমাজের উন্নয়নে তাদের ইচ্ছা পোষণের এই সুযোগ পাবেন না? এখন মেয়েরাও তো সংগঠক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক শিল্পী, জজ, ব্যারিস্টার, ম্যাজিস্ট্রেট, ওসি, ডিসি, এসপি, প্রতিষ্ঠানের প্রধান, পরিচালক, এমডি, চেয়ারম্যান, সচিব, মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রী হয়ে এই বাংলাদেশই চালাচ্ছেন। ৪ বারেরবার দেশ শাসন করছেন জননেতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তাহলে এই বড় রকমের ব্যবসার সুযোগ কেন নারীদের দেওয়া হবে না? তারা তো অন্যের হাতে তার আদরের পশুটি বিক্রি করতে দিয়ে তাদের অধিকার হারাচ্ছেন। সারা বছর কষ্ট করে, অর্থ ব্যয় করে অনেক আশা বুকে বেঁধে লালন পালন করছেন। তাদের পশু অন্যের হাতে খাইনা তখন আঘাত করা হয়। গোসল করাতে পারেনা, তখনো পশুর গায়ে আঘাত করে, মারে।

এটা নারীর তরফ থেকে দেখভাল পরিচালনা করলে হয় না? এইজন্য মেয়েরাও অন্তত এই কোরবানির সময় বছরে একটা সিজন তারা তাদের হাতে পালা পশু নিজে থেকে নিজের হাতে লালন পালন করে বিক্রয় কাজ সম্পন্ন করতে চান। তাই তারাও থাকতে পারবেন তাদের পশু নিয়ে, সেভাবেই একটা পরিবেশ তারা চান।

যেই স্পেসের সবই নারী কতর্ৃক পরিচালিত হবে। থাকা খাওয়ার আবাসিক হোটেল, খড়, ভুসি বিক্রয় কেন্দ্র, দোকান, আরো অন্যান্য এবং গার্ড সিকিউরিটি পুলিশ যাবতীয় সেকশন নারী দ্বারাই চলবে, ঠিক এমনটাই তারা পেতে চান। তারা মনে করেন, ুেকারবানীর পশু আমরা যদি এভাবে বিক্রি করতে পারি, তাহলে তো অনেক নারী ক্রেতাও মিলবে। নারীরা নারীদের থেকে ভালোভাবে দেখে শুনে বুঝে পছন্দের পশুটি কোরবানীর জন্য নিতে পারবেন অনেক নিরাপদে। এভাবে উভয়েই লাভবান হবে, কেউ প্রতারিত হবে না।

তাই, পশু পালন এর বিষয়ে কর্মজীবী নারীদের যে দাবি, তা অবশ্যই সঠিক এবং এটার যথাযথ বাস্তবায়ন হবে বলে আশা রাখি।

-সৈয়দা রাশিদা বারী
লেখক: সাংবাদিক, কবি ও গীতিকার
Facebook Comments Box

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রিসেট বাটনের চাপে বাংলাদেশ ওলটপালট ও ইতিহাসের দায়!

দশটি খাতে ইন্টেলিজেন্ট সল্যুশন ও ফ্ল্যাগশিপ পণ্য উন্মোচন করলো হুয়াওয়ে

সোনালী লাইফ ইনসুরেন্স থেকে অর্থ তসরুফে অভিযুক্ত মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের দেশত্যাগের চেষ্টা

আমরা কুঁড়ির বিশ্ব শিশু দিবস পালিত

শাহজাদপুরে মাদকদ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল

উল্লাপাড়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যার দায়ে স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

সোনালী লাইফের ৩৫৩ কোটি তছরুপ, কুদ্দুসের পকেটেই ১৮৪ কোটি টাকা

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে বন্ধ হইতে যাচ্ছে ইটখোলা: বেকার হযবে শতাধিক পরিবার “সরকার হারাবে রাজস্ব”

বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতির লাগাম টানার এখনই সময়

নাশকতার মামলায় স্বেচ্ছাসেবক লীগের দু নেতা গ্রেপ্তার

১০

দুটি ইন্সুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান সব সরকারের সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী ~মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস

১১

শমসের মবিন চৌধুরী আটক

১২

উল্লাপাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

১৩

জৈষ্ঠ্য শিক্ষককে পাশ কাটিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিলেন কনিষ্ঠ শিক্ষক

১৪

আওয়ামী লীগের আর কোন ভবিষ্যত নেই ..অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন

১৫

ছাতকে আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ১৫০ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা

১৬

সংকটময় সময় আমাদের করণীয়

১৭

বাংলাদেশের উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্নের এখন দুঃস্বপ্ন

১৮

চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৪ শতাংশ : বিশ্বব্যাংক

১৯

উল্লাপাড়া বিজ্ঞান কলেজ জেলার শীর্ষে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে

২০