সরকারি কর্ম কমিশনের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস নিয়ে একে একে বের হয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রশ্নফাঁসের চক্রের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন পিএসসির তিন কর্মকর্তা। কঠিন নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভেতরেও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বের করতেন এই চক্রের সদস্যরা। এরপর মোটা অঙ্কের টাকার বিনিমিয়ে চক্রের বাকি সদস্যদের মাধ্যমে প্রার্থীদের কাছে পৌঁছে যেত প্রশ্নপত্র। এক্ষেত্রে মানা হতো কড়া সিরিয়াল ও কঠিন শর্ত। তারা ব্যবহার করতেন অফিস সহায়ক, গাড়ি চালকদের। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে পিএসসির তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জন গ্রেপ্তার হওয়ার পর বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তে উঠে এসেছে বড় বড় কর্মকর্তার নাম। পিএসসির উপ-পরিচালক মো. আবু জাফর ও মো. জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির এই চক্রের মাথা। চক্রের বাকি সদস্যরা কেউ চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহ করতেন, কেউ প্রশ্নপত্র পেয়ে তা সমাধান করতেন, কেউবা চাকরি প্রার্থীদের ঢাকায় এনে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি টাকার অঙ্ক নির্ধারণ করতেন।
সিআইডির তথ্যমতে, পিএসসির উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর, জাফর ও সহকারী পরিচালক আলমগীর প্রশ্নফাঁস করতেন। এরপর খলিলুর রহমান ও সাজেদুল ইসলামের মাধ্যমে চাকরিপ্রার্থীদের প্রশ্ন সরবরাহ করতেন। মোটা অঙ্কের টাকা বিনিময়ে পরীক্ষার্থীদের বাসায় এনে উত্তরপত্র পড়াতেন তারা। আর পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী টাকা লেনদেন ও প্রশ্নফাঁসের বুথ পরিচালনা করতেন।
সিআইডি বলছে, পিএসসির কোনো নিয়োগ পরীক্ষা এলেই চক্রের সদস্যরা প্রশ্নফাঁস করে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেন। গত ৫ জুলাই রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস করেন তারা। চুক্তি অনুযায়ী পরীক্ষার আগের রাতে পরীক্ষার্থীদের বাসায় এনে প্রশ্ন ও উত্তরপত্র দিয়েছেন। তদন্তে এখন পর্যন্ত অনেকের নাম সামনে এসেছে। তাদের মধ্যে হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিও রয়েছে। সবার তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় হবে।
বিসিএসসহ পিএসসির অধীনে অনুষ্ঠিত ‘বিসিএস প্রিলি–লিখিতসহ গুরুত্বপূর্ণ ৩০ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস’ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এরপর সোমবার (৮ জুলাই) রাতে বিপিএসসির তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাতেই রাজধানীর পল্টন থানায় বিপিএসসি আইনে মামলাটি দায়ের করেন সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের সাইবার ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) নিপ্পন চন্দ্র চন্দ। মামলায় ৩১ জনের নামোল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরো ৫০/৬০ জনকে আসামি করা হয়। তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার ১৭ জনকে মঙ্গলবার আদালতে হাজির করা হয়েছে।
মামলার এক নম্বর আসামি সৈয়দ আবেদ আলী (৫২)। তিনি দীর্ঘদিন পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দুই নম্বর আসামি নোমান সিদ্দিক (৪৪)। লক্ষ্মীপুরের রামগতি এলাকার বাসিন্দা গার্মেন্টস (পোশাক) ব্যবসায়ী নোমান থাকতেন মিরপুর-১০ সেনপাড়া পর্বতা এলাকায়। তিন নম্বর আসামি খলিলুর রহমান (৩৮)। চার নম্বর আসামি মো. সাজেদুল ইসলাম (৪১)। পাঁচ নম্বর আসামি মিরপুর ইসিবি চত্বরের ডেভেলপার ব্যবসায়ী আবু সোলেমান মো. সোহেল (৩৫)। ছয় নম্বর আসামি পিএসসির উপ-পরিচালক (সিলেট) জাহাঙ্গীর আলম (৫৮)। সাত নম্বর আসামি পিএসসির সহকারী পরিচালক এসএম আলমগীর কবীর (৪৯)। আট নম্বর আসামি গাজীপুর সেনানিবাসের অডিটর প্রিয়নাথ রায় (৫১)। নয় নম্বর আসামি মিরপুরের জাহিদুল ইসলাম (২৭)। দশ নম্বর আসামি পিএসসির উপ-পরিচালক মো. আবু জাফর (৫৭)।
বাকি আসামিরা হলেন- নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশীদ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিকেল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুল হাসান, ব্যবসায়ী সহোদর সাখাওয়াত হোসেন ও সায়েম হোসেন এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লিটন সরকার ও সৈয়দ আবেদ আলীর ছেলে ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম।এখনো পলাতক রয়েছে, পিএসসির সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়, শরীফুল ইসলাম ভূঁইয়া, দীপক বনিক, খোরশেদ আলম খোকন, কাজী মো. সুমন, এ কে এম গোলাম পারভেজ, মেহেদী হাসান খান, গোলাম হামিদুর রহমান, মুহা. মিজানুর রহমান, আতিকুল ইসলাম, এটিএম মোস্তফা, মাহফুজ কালু, আসলাম ও কৌশিক দেবনাথ।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) বিশেষ পুলিশ সুপার মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, মামলায় এখন পর্যন্ত ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সাবেক পিএসসি চেয়ারম্যানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ সাতজন দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। গ্রেপ্তারদের থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যাচাই-বাছাই চলছে। এ চক্রের সঙ্গে আরো যারা জড়িত রয়েছেন প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে।
মন্তব্য করুন