৫ আগস্ট ২০২৪ এর পর থেকে শুরু করে গত দুই মাসে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, ৩০ লাখ শহীদ, বীরাঙ্গনা, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা, সংবিধানের প্রতি অবমাননাকর যত ঘটনা ঘটছে, যারা ঘটিয়েছে, তার অধিকাংশই বিভিন্ন ইউএটিউব চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। এছাড়া বেশকিছু টিভি চ্যানেলের সংরক্ষণে রয়েছে। এসব ভিডিও দেখে অপরাধীদের সনাক্ত করে, তাদেরকে গ্রেফতার করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করি। এতোদিনেও এসব বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে নিষ্ক্রিয়তা মানে সরকারের দুর্বলতা, অথবা এ সকল অপরাধকে সমর্থন করা!
এদেশের রাজনৈতিক উদ্যানে আওয়ামী ফুল ফুটানো এখন সময়সাপেক্ষ,ক্ষমতার পূর্ববর্তী পালাবদল তাই বলে।শুধু উত্তাল সমুদ্র পার হতে শক্ত হাতে বৈঠা ধরে থাকা লাগবে। ড. ইউনুস জাতিসংঘে ভাষনে বলেছেন তার সুদীর্ঘ পরিকল্পনায় শেখ হাসিনা সরকার উৎখাত করেছেন। ড. ইউনুস বলেছেন তরুণরা রিসেট বাটন টিপেছে, তরুণরাই নতুন বাংলাদেশ গড়বে। এখন প্রশ্ন হলো তরুণদের মধ্যে কারা রিসেট বাটন টিপেছে? হিজবুত তাহরীর বা শিবিরের বা মাদ্রাসার ছাত্র মৌলবাদী মাহফুজ আলম চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তিকে গুরুত্ব দিতে। আমি কে তুমি কে রাজাকার রাজাকার স্লোগান তারই তৈরি।
শত শত পুলিশকে যে জবাই করা হলো, জঙ্গি ছাড়া আর কেউ ওভাবে জবাই করতে পারে? বিপ্লবের নীল নকশা যে এঁকেছে, সে-ই তো পুলিশ হত্যার নির্দেশ দিয়েছে। দেশব্যাপী যে সন্ত্রাস চলেছে, এবং এখনও চলছে, এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকার থেকে কোনও পদক্ষেপ না নেওয়া, তাছাড়া জেল থেকে সাজাপ্রাপ্ত সব জঙ্গি আর জিহাদিদের মুক্তি দেওয়া তো প্রধান উপদেষ্টা আর তাঁর সহকারীরই নির্দেশ। জঙ্গিরাই তো জঙ্গিদের মুক্তি দেয়। সে যে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি দিয়ে দেশ চালাতে চেয়েছিল, এবং সফল হয়েছে, সে তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। দেশে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য ছিল, মিউজিয়াম ছিল, ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। তাছাড়া রিসেট বাটন টিপে দিয়েছে মাহফুজ আলম। সেটা মহম্মদ ইউনুসও ঘটা করে এবং বেশ গর্ব করে জানিয়েও দিয়েছেন। মাহফুজ আলমের প্ল্যান ছিল জনতার সমর্থন পাওয়া, সে কারণে বুদ্ধি এঁটেছিলেন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে দেশের গান গাওয়া, জনতা এসব দেখেই ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। এতে মিছিল ফুলেছে। অজগরের মতো দীর্ঘ হয়েছে।
সরকার পতনের পরই শুরু হলো সাপের ছোবল। ছোবলে নীল হয়ে গেল গোটা দেশ। মাহফুজ আলমের যে সৈনিকেরা, যে ছাত্ররা, মাথায় জাতীয় পতাকা নিয়ে ধন ধান্য পুষ্প ভরা গেয়েছিল, তারাই জঙ্গি দল আইসিসের পতাকা মাথায় নিয়ে নারায়ে তকবির স্লোগান দিয়ে মিছিল করছে এখন। মাহফুজের ছাত্র-সৈনিকেরা তাদের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ওড়াচ্ছে পাকিস্তানের পতাকা, আইসিস জঙ্গিদের পতাকা। হিন্দুদের মূর্তি ভাঙ্গা, মন্দির জ্বালিয়ে দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে গ্রেফতার করা, খুন করা, পিটিয়ে হত্যা করা এখনও চলছে। নিশ্চয়ই ওপর তলা থেকে এমনই আদেশ এসেছে।
বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ধানমন্ডির বাড়ি সমস্ত আসবাবপত্র লুটপাট, ভাংচুর, আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। গণভবনে ঢুকে লুটপাট, চুরি,এমনি ইট পর্যন্ত নিয়ে গেছে, তেজগাঁও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে সব কিছু লুটপাট করেছে, ধানমন্ডির সুদা সদনে লুটপাট, ভাংচুর, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অফিস গুলিস্তানের ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, আওয়ামী লীগের সভাপতি রাজনৈতিক কার্যালয় ৩/১ ধানমন্ডি লুটপাট, ভাংচুর, পুড়িয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে লুটপাট করেছে । বাড়ি অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে। গণহারে হত্যা করে চলছে। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। থানায় হামলা চালিয়ে অস্র লুটপাট করেছে, থানা পুড়িয়ে দিয়েছে। থানার ভিতর সব গাড়ি পুড়িয়ে জঙ্গি জিহাদিদের জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
যত ধর্ম ব্যবসায়ী ওয়াজি, সব দেশে ফেরত এসেছে। দেশে জামাতে ইসলামির রাজত্ব। নিষিদ্ধ জঙ্গি গোষ্ঠী হিযবুত তাহরীরের মিছিল মিটিং ফ্ল্যাগ পোস্টার প্রকাশ্যেই চলছে। আইসিসের ফ্ল্যাগ প্রদর্শন চলছে। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধাদের সব ভাস্কর্য ভাঙ্গা হয়ে গেছে, হিন্দুর দেব দেবীর প্রচুর প্রতিমা ভাঙ্গা হয়ে গেছে, মাজার ভাঙ্গা সারা, আদিবাসিদের বাড়ি ঘরে উপাসনালয়ে হামলাও কমপ্লিট। এখন বৌদ্ধরা জানিয়ে দিয়েছে কঠিন চীবর দান নামে যে অনুষ্ঠান তারা করতো, সেটি করবে না। হিন্দুদের পুজো মন্ডপে পাহারা বসিয়েছিল। কাদের হাত থেকে তারা বাঁচাতে চাইছে মণ্ডপ? পুলিশ যথেষ্ট নেই, ভয়ে তারা কাজে আসছে না। যেভাবে জবাই করা হয়েছে পুলিশকে! ট্রমাই কাটেনি পুলিশের। যে নেতা সরকারের পতন ঘটিয়েছিল, খবর বেরিয়েছে তাদের অধিকাংশের নাম জামাতে ইসলামির ছাত্র সংগঠন শিবিরের খাতায় লেখা। তাদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধ কেন হয়েছিল সেই ইতিহাসই জানে না। মাদ্রাসায় মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পড়ানো হয় না। মাদ্রাসা পরবর্তী পাঠচক্রে যোগ দেওয়া ছেলেপুলেদের ইন্টেলেকচুয়াল ভাবার কোনও কারণ নেই। পাঠচক্রে ইসলামি বইও থাকে, যেসব বইয়ে শর্টকাটে জান্নাত কী করে পাওয়া যায় তার নকশা থাকে, খিলাফত কী করে প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তারও কায়দা কানুন থাকে।
প্রকাশ্যে এসেই তৎপর সুব্রত বাইন, ‘পিচ্চি হেলাল’, ‘কিলার আব্বাস’সহ শীর্ষ সন্ত্রাসীরা ৫ আগস্ট এর পর আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে অন্তত ছয়জন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই এক থেকে দেড় যুগের বেশি সময় ধরে কারাগারে ছিলেন। জামিনে মুক্ত হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে আছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ‘কিলার আব্বাস’ হিসেবে পরিচিত মিরপুরের আব্বাস আলী, তেজগাঁওয়ের শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, মোহাম্মদপুরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, হাজারীবাগ এলাকার সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন। এ ছাড়া ঢাকার অপরাধজগতের আরও দুই নাম খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসুও কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তাঁদের বাইরে বিদেশে থাকা কোনো কোনো সন্ত্রাসী আবার দেশে ফেরার চেষ্টা করছেন বলেও আলোচনা আছে।
এ ছাড়া আত্মগোপনে থাকা কেউ কেউ প্রকাশ্যে এসেছেন। এমনই একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন।
বাংলাদেশের জামাত-শিবির, হেফাজতি-হিযবুতি, আইসিস-আনসারুল্লাহ জিহাদি-জঙ্গি, সন্ত্রাসী-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দেশ আজ শুধু জামাত শিবিরের হাতে বন্দি নয়, জামাত শিবিরের বাপ হিযবুত তাহরীর আর আইসিস জঙ্গিদের হাতে বাংলাদেশটা এখন হিযবুত তাহরীরের দেশ হয়ে গেছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে হিযবুত তাহরীরের জিহাদিরা আবার তাদের কেউ হিযবুত তাহরীরের জিহাদি বলুক, সেটা একেবারেই চায় না। পরিচয় লুকিয়ে রাখার বদঅভ্যেস হয়ে গেছে সবার। ঠিক যেমন ‘শেখ হাসিনা হঠাও’ আন্দোলনে নিজেরা যে হিযবুতি, সেটা লুকিয়ে নিজেদের ”সাধারণ শিক্ষার্থী” ঘোষণা দিয়েছিল, তেমন এখন হিযবুতিগুলো বলতে চায় তারা ‘নিরীহ জনতা’। হিযবুতিদের মধ্যে এক দল সরাসরি সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত, জবাই করার ট্রেনিং নিয়েছে, আরেক দল ট্রেনিং নেয়নি, কিন্তু মানসিকভাবে জড়িত অর্থাৎ তারা জিহাদি আদর্শের সমর্থক।
ড. ইউনুস শুধু হাসিনাকে ঘৃণা করেন না। এখন দেখছি তিনি শেখ মুজিবকে ঘৃণা করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ঘৃণা করেন, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকে ঘৃণা করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ঘৃণা করেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাঙালির বিজয় অর্জনকে ঘৃণা করেন, তিনি বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রকে ঘৃণা করেন। শুধু তাই নয়, যে বিশ্বাসঘাতক রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ৩০ লক্ষ বাঙালিকে খুন করেছিল আর ২ লক্ষ নারীকে ধর্ষণ করেছিল– তাদের তিনি সমর্থন করেন। ড. ইউনুস নিঃসন্দেহে দেশদ্রোহী এবং জিহাদি সমর্থক। এক প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষ কতগুলো জিহাদির সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে একটা গোটা দেশের ইতিহাস মুছে দিতে চাইছেন, আর আত্মপরিচয় গোপন করে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে জিহাদিরা যে সরকার পতন ঘটালো, সেটিকে তিনি মুক্তিযুদ্ধ বলতে চাইছেন, শুধু তাই নয়, ৫২র মহান ভাষা আন্দোলনকে আর ৭১এর মহান মুক্তিযুদ্ধকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে চাইছেন। তাঁর চেহারাটি এখন আর মানুষের মতো নয়, দানবের মতো মনে হচ্ছে। পুরনো শকুন জাতির পতাকা খামছে ধরেছে। যার এদেশের প্রতি বিন্দুমাত্র অনুভূতি,মায়া,ভালবাসা, দেশপ্রেম নেই। এদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য কিছুই বিশ্বাস করে না, ধারণ করে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে শ্রদ্ধা করে না,ভালবাসে না। তাকে আমরা কি বলবো!
ইউনুস সরকার আটটি জাতীয় দিবস ইতিমধ্যে বাদ দিয়ে প্রজ্ঞাপন দিয়েছেন, তারমধ্যে অন্যতম বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ দিবস, ৪ই নভেম্বর সংবিধান প্রণয়ন দিবস, ১৫ই আগষ্ট জাতীয় শোক দিবস এসব বাদ দেওয়ার কারনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ সবাই ব্যথিত হয়েছেন। ইতিহাসে আমাদের দায় আছে কিনা ভেবে দেখা উচিত নয় কি?
লেখক: সেলিম রেজা
বাংলাদেশ ইতিহাস ঐতিহ্য কেন্দ্র সংগঠন।
মন্তব্য করুন