সবেমাত্র সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কালীপূজা শেষ হয়েছে। দীপাবলির আলোর রোশনাইয়ের রেশ এখনো পুরোপুরি কাটেনি। আর এদিকে বাংলাদেশের সমাজ তথা রাজনীতি’র আকাশের ঘোর অমাবস্যা যেন কাটতেই চাইছে না! তিমিরাচ্ছন্ন এই দুর্দিন দেখে আকছার মনে হয়, দেশে যেন ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত সিজন ২.০’ চলছে! মাস তিনেক আগে ‘স্বাধীনতা ২.০’ অর্জিত হলেও, এই ‘আইয়ামে জাহেলিয়াতের দ্বিতীয় সংস্করণ’ চলছে বোধহয় আরও বহু আগে থেকেই! কেতাবি ভাষায়, ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’-কে বলা হয় ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ’, যা আমরা কমবেশি সবাই জানি। সেই যুগে মানুষ চরম অজ্ঞতা আর মূর্খতায় ডুবে মজেছিল নিষিদ্ধ নেশায়, লিপ্ত হয়েছিল জঘন্য সব অপরাধকর্মে!
আর এই ‘জেন-জি’দের জমানায় এসেও মানুষ এখনো অপরাধের ত্রিসীমানা ছাড়তে পারে নি! তবে ফারাক হচ্ছে, এই যুগে দাঁড়িয়ে অপরাধের ধরন-ধারন ঢের পাল্টেছে! যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা! আগে হত্যা করার পর লাশ হয় কোথাও ফেলে নচেৎ পুঁতে ফেলা হতো আর এখন যত্ন করে তা ফ্রিজে রাখা হয়! কখনো অ্যাসিডে ঝলসে দেয়া হয়! ‘টেকনোলজিক্যাল এক্সিলেন্স’ কেবল জীবনের বাদবাকি ক্ষেত্রেই সাধিত হয় নি, ‘ক্রাইম ওয়ার্ল্ডে’ও আজ এর পা পড়েছে!
ভারতীয় টিভি সিরিজ ‘ক্রাইম প্যাট্রোল’ দেখেই হোক নতুবা নেটফ্লিক্সের মারদাঙ্গা থ্রিলার কাহিনীর কল্যাণেই হোক, গতানুগতিক ধারার নির্ভেজাল মানব মস্তিষ্ক আজ ‘ফাইভ-জি’র ছোঁয়া পেয়ে একদম ফার্স্ট ক্লাস ‘ক্রিমিনাল মাইন্ডে’ রূপান্তরিত হয়েছে! ইদানীংকালে ঘটে যাওয়া নির্মম হত্যাকাণ্ড কিংবা অন্যান্য অপরাধের বীভৎসতা দেখে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এইসব ‘কালপ্রিট’ যেন একেকজন ‘ক্রাইম ওয়ার্ল্ডে’র ‘ফার্স্ট বেঞ্চার’!
শ্রদ্ধাবোধ তো শিকেয় তুলে রেখেছে আরও আগেই এমনকি ন্যূনতম ভয়-ভীতিও যেন নেই! আসলে মানুষ এখন আর ঠিক সেইভাবে আইনের চোখ রাঙানিকে তোয়াক্কা করছে না! মানব মস্তিষ্কে থাকা প্রতিটি ‘নিউরন’ যেন শয়তানি ক্রিয়াকলাপের একেকটি ‘পাওয়ার হাউজ’ হয়ে উঠেছে!
আর এই শক্তিকেন্দ্র থেকে উদ্ভূত শক্তিই ‘ড্রাইভিং ফোর্স’ বা ‘চালিকা শক্তি’র ভূমিকায় মানুষকে ধাবিত করছে আঁধার ঘেরা অপরাধের দুনিয়ায়! যেই জগতে কেউ একবার এসে পড়লে সে আর ফাঁদ কেটে বেরিয়ে আসতে পারে না! নীল বিষে বিষাক্ত ‘ক্রিমিনাল মাইন্ড’ কিংবা অজান্তেই নিজের ভেতরে বেড়ে ওঠা ‘গডফাদার’ তাঁকে টেনে আরও গহীনে নিয়ে যায়! অপরাধের হাতছানি তাঁর পিছু ছাড়ে না আর বেখেয়ালে সে হয়ে ওঠে ‘সিরিয়াল কিলার’, ‘রেপিস্ট’ কিংবা আরও ভীতি জাগানিয়া কেউ!
আর এইসব অপরাধের ভয়ংকরী রূপ দেখে তো সাধারণের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়! আতংক হয় কি সাধে, কাঁর কোনদিন মৃত্যুবীজ রোপিত হয় তা আগেভাগে কেই বা বলতে পারে!
দেশের ‘আইন’ আজ কেবল ওই ‘ফাইন’ করা অব্দি আটকে আছে! মাঝেসাজে দু’চারটা যাবজ্জীবন নতুবা খুব বেশি চাপে পড়লে মহামান্য আদালত কদাচিৎ দু’একটা ‘ডেথ পেনাল্টি’ পড়ে শোনান! এর বেশি কিছু তো হয় না। ঘুরে ফিরে ওই ‘গ্রেপ্তারি পরোয়ানা’ আর এর পেছনে কদিন সরকারি গাড়ির তেল পুড়িয়ে বেদরকারি, স্রেফ লোক দেখানো লম্ফঝম্ফ! মানুষ লিটেরেলি হাঁপিয়ে উঠেছে! তবুও কিচ্ছুটি বলার জো নেই কেননা, ‘দ্য বস ইজ অলওয়েজ রাইট’! ধুমসে কদিন ধরে চলে এই ‘ইনভেস্টিগেশন’ নামক ড্রামা-সিরিয়াল! একেকবার ‘স্টোরি’ হয়তো আলাদা হলেও কলাকুশলী সবাই একই ‘সরকারি’ দলের!
মশলা মাখানোর জন্য কখনো গল্পের মধ্যে থাকে একটু আধতু ‘টুইস্ট’ আর পাবলিকের নজর ঘোরানোর জন্য রিডিকুলাস ‘টার্নিং পয়েন্ট’! মিডিয়ার লোকেরা পারলে যেন নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে ওই ‘ব্রেকিং নিউজ’টাই গিলে খায়! ব্যস, মার দিয়া কেল্লা! তারপর আবার সব আগের মতো। নো অ্যাকাউন্টেবিলিটি! নো চেইঞ্জ!
গোটা দেশটাই হয়ে উঠেছে অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য আর এদিকে আমরা দেখছি ‘স্বপ্নের বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের দিবাস্বপ্ন! পথে-ঘাটে যেখানে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে ‘ক্রিমিনাল মাইন্ড’, আমরা সেখানে হাতে হারিকেন নিয়ে খুঁজে ফিরছি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানের ‘মাস্টারমাইন্ড’! তাঁকে খুঁজে বের করতে আমরা যেন একেকজন ‘সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ’ হয়ে উঠেছি, অনুসন্ধানী চোখে আতশ কাঁচ হাতে উঠে পড়ে লেগেছি! কোনো রাজনৈতিক বোদ্ধা তো আবার গোটা ‘গণঅভ্যুত্থান’-কে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রেখে চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্যস্ত রয়েছেন যে, ‘কে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের নেপথ্যের নায়ক’!
আইনশৃঙ্খলার অধোগতি কিংবা অপরাধের লাগামছাড়া লাফ-ঝাঁপ, যেভাবেই বিষয়টিকে দাঁড় করাই না কেন, সবকিছুকে বেমালুম একপাশে সরিয়ে রেখে ‘টিম উপদেষ্টা’ তার সভাসদ বাড়িয়েই চলেছে। ভাবখানা যেন, তাঁদের কাছে এইসমস্ত ইস্যু একেবারে নস্যি! ছোটখাট অপরাধ হিসেবে তাচ্ছিল্য কিংবা চুনোপুঁটি বলে এইসব ক্রিমিনালদের রেয়াত করা যায় না, কে বলতে পারে হয়তো এঁদের জন্যই কোনোদিন ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করতে হলো!
প্রবাদ আছে, ‘অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট’। আবার এও সত্য যে, ‘ওস্তাদের মার শেষ রাতে’! তবে অদ্যাবধি ‘ইউনূস মিনিস্ট্রি’ একেবারেই গড়পড়তা চলছে। ক্ষণিকের পলিটিশিয়ান এই উপদেষ্টারা দেশের হাল ধরবেন নাকি আরও বেহাল করবেন তা সময়ই বলে দেবে।
লেখকঃ আসিফ আল মাহমুদ
চট্টগ্রাম থেকে,
পেশাঃ ফ্রিল্যান্স রাইটার।
মন্তব্য করুন