ভূমি নিবন্ধন আইনে এখনো পুরাপুরি জটিলতা সংস্কার হয়নি, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নেই কোনো নজরদারি, ভূমি ও এসি ল্যান্ড অফিস নতুন রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি
অনুসরণ না করে সনাতন পদ্ধতিতেই চলছে বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের।
সংশোধিত আইনের বাস্তবায়ন চান বিশেষজ্ঞরা
কারো কাগজ আছে, দখল নেই। কারো আবার দখল আছে, কাগজ নেই। একজনের জমি বিক্রি করছেন অন্যজন। এক মালিকের জমি রেকর্ড হয়েছে আরেকজনের নামে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মালিকের নাম ও জমির পরিমাণও ভুল লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ভুয়া মালিক সাজিয়ে আম-মোক্তারনামার মাধ্যমে সৃজন করা হচ্ছে ভুয়া দলিল। রাজস্ব ফাঁকি দিতে নিবন্ধনে ছলচাতুরির আশ্রয় নিচ্ছেন খোদ নিবন্ধন কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই।
ফলে একদিকে যেমন বাড়ছে দেওয়ানি মামলার হার, তেমনি সরকারও হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। যেন সমস্যার অন্ত নেই। সহজে সমাধানেরও উপায় নেই। দেশে জমিজমা-সংক্রান্ত বিরোধের শেষ নেই। শেষ নেই মামলা-মোকদ্দমারও।
দেশের ৭০ শতাংশ ফৌজদারি অপরাধ সংগঠিত হয় ভূমিকেন্দ্রিক বিরোধের জেরে। ভূমি নিবন্ধন আইনে ভূমি খাতের জটিলতা বাড়াচ্ছে। ভূমি কার্যালয় গুলোতে নামজারি, খতিয়ান উত্তোলন, ভূমি অধিগ্রহণের অর্থ প্রাপ্তিসহ নানা ক্ষেত্রে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে ভূমির মালিকদের। রয়েছে নানা দুর্নীতির অভিযোগ।
এছাড়া নিবন্ধনের সময়ে দলিলে জমির প্রকৃত শ্রেণি উল্লেখ না করে রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা অহরহই ঘটছে। এতে প্রতি বছরই বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। আবার রাজধানীর অনেক জায়গায় ভূমি বা ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে নিবন্ধনমূল্য প্রকৃত বাজারমূল্যের কাছাকাছি না থাকায় রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা ঘটছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন সংশোধন হলেও পুরোনো আইনেই চলছে ভূমি নিবন্ধন প্রক্রিয়া। তাই সংশোধিত আইন কার্যকর ও বাস্তায়িত করতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিস, তহসিল অফিস, এসি (ল্যান্ড) অফিস, ভূমি জরিপ ও রেকর্ড সংরক্ষণকে আধুনিক পদ্ধতির আওতায় নিয়ে এলেই আইনের সুফল মিলবে বলে মনে করেন তারা। এটি করা গেলে ভূমি বিরোধ বহুলাংশে হ্রাস পাবে। আদালতের ওপর থেকে মামলার চাপও কমবে।
আইনজীবীরা বলছেন, ভূমি আইন সংশোধন করা হলেও সুফল মেলেনি। বরং আরো জটিলতা বেড়েছে। কারণ তথ্যপ্রযুক্তি এগিয়ে গেলেও ভূমি রেজিস্ট্রেশন ব্রিটিশ আমলের ম্যানুয়াল পদ্ধতিতেই চলছে। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রেকর্ড অব রাইটসের কপি না থাকায় উচ্চমূল্যের ভূমির শ্রেণি গোপন করে অপেক্ষাকৃত নিম্নমূল্যের শ্রেণি দলিলে লিপিবদ্ধ করে জাল পর্চা ও দাখিলা উপস্থাপনের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ প্রবণতা বন্ধে উন্নত দেশের আদলে ভূমি-সংক্রান্ত সব প্রক্রিয়াকে ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনা প্রয়োজন বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।
তারা বলছেন, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ভূমির শ্রেণি নির্ধারণের তথ্য না থাকায় সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। ভূমি অফিসকে ডিজিটাল করা গেলে এ ধরনের কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ বন্ধ হবে। আবার জমির মালিকানা-সংক্রান্ত তথ্যের প্রয়োজনে সহজেই তা পাওয়া সম্ভব হবে।
নিবন্ধন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জমিজমা-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন, ভূমি হস্তান্তরে স্বচ্ছতা আনয়ন, জালিয়াতি রোধ এবং ভূমি ব্যবস্থাপনা সহজীকরণের লক্ষ্যে সরকার ২০০৪ সালে ভূমি রেজিস্ট্রেশন (সংশোধন) আইন-২০০৪ কার্যকর করে। এ আইন তাৎক্ষণিকভাবে ভুক্তভোগীদের মহলের প্রশংসা কুড়ায়। কিন্তু কিছুদিন যেতেই আইনটিতে ধরা পড়ে বহু অসঙ্গতি। আইনটিতে নিবন্ধন পদ্ধতি সংস্কারের কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি।
নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় জালিয়াতি ও রাজস্ব ফাঁকির। ভূমি হস্তান্তর প্রক্রিয়া সহজিকরণ করা হলেও ভূমি রেজিস্ট্রেশন আরো জটিল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো পুরোনো নিয়মে পরিচালিত হওয়ায় হস্তান্তরযোগ্য ভূমির শেষ ২৫ বছরের ইতিহাস, এসএ পর্চা, আরএস পর্চা এবং নামজারির ক্ষেত্রে আগের জটিলতাই রয়ে গেছে। বরং ভূমি হস্তান্তর প্রক্রিয়ার অর্ধেক অংশ (রেজিস্ট্রেশন) নতুন নিয়মে অর্ধেক সনাতন (নামজারি, এসএ পর্চা, আরএস পর্চা) নিয়মে করতে হয়। ফলে মানুষ এখনো নতুন রেজিস্ট্রেশন আইনের পূর্ণ সুফল পাচ্ছে না।
জানা গেছে, বর্তমান আইনে রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে দাতা-গ্রহীতার ছবি সংযুক্তকরণ বাধ্যতামূলক করা হলেও এর মাধ্যমে জালিয়াতি রোধ করা যাচ্ছে না। ভুয়া ব্যক্তিকে জমির মালিক বানিয়ে বিক্রয় নিবন্ধন চলছে। এ ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশনকালে ভুয়া ব্যক্তির ছবি ব্যবহার করা হলেও পরে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মচারীদের যোগসাজশে জমির প্রকৃত মালিকের ছবি সংগ্রহ করে গোপনে যুক্ত করে দেয়া হচ্ছে।
এভাবে জমির প্রকৃত মালিকের অজ্ঞাতেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে তার জমি। প্রকৃত মালিক জমি ফেরত পাওয়ার জন্য অবলম্বন করতে হচ্ছে মামলা-মোকদ্দমার দীর্ঘ পথ। জমি নিবন্ধনে জালিয়াতি রোধ করা না গেলে দেওয়ানি মামলার হার বাড়তেই থাকবে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা।
তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে আসা আজিজুল হক নামের ভুক্তভোগী জানান, তার জমির ২৫ বছরের ইতিহাসের এক পর্যায়ে একজন সংখ্যালঘুর নাম চলে আসে। এ জন্য তাকে অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়েছে। ভূমি অফিস এবং এসিকে (ল্যান্ড) নতুন রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতির আওতায় না আনায় জমির অনেক প্রকৃত মালিকও জমি হস্তান্তর করতে পারছেন না। আর এসব জটিলতার কারণেই আইন থাকা সত্ত্বেও জালিয়াতি কমেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মানিকগঞ্জ পালপাড়া গ্রামের সফিউদ্দিনের স্ত্রী রহিমা খাতুন। তিনি ভাটভাউর মৌজার ৮১ শতাংশ জমির আমমোক্তারনামা দেন বান্দুটিয়ার মো. ওবায়দুল কবীর এবং পশ্চিম দাশড়ার মো. সালাহউদ্দিনকে। মানিকগঞ্জ সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে পৃথক দুটি দলিলে (নং-৪৪৭৯ ও ৪৪৮০) আমমোক্তারনামা দুটি নিবন্ধিত হয়। কিন্তু পরের মাসে সিঙ্গাইর থানার জয়মণ্ডপের আরেক মহিলাকে রহিমা খাতুন সাজিয়ে প্রকৃত রহিমা খাতুনের আমমোক্তারনামা বাতিল করা হয়।
মানিকগঞ্জ সদরের সাব-রেজিস্ট্রার মহসিন মিয়া কমিশনে কথিত রহিমা খাতুনের বাসায় গিয়ে আমমোক্তারনামা বাতিল এবং স্বত্ব দখলীয় ভূমির মালিকানা ফিরিয়ে নেয়ার দলিলটি (নং-৫২৯৯ এবং ৫৩০০) নিবন্ধন করেন। পরে একই জমি ভুয়া রহিমা খাতুনকে দিয়ে সাতটি দলিলের (নং-৫৪৩৮ থেকে ৫৪৪৪ পর্যন্ত) মাধ্যমে বিভিন্ন জনের কাছে বিক্রি ও দানপত্র নিবন্ধন করেন মহসিন মিয়া।
জমির প্রকৃত মালিক রহিমা খাতুনের ছবি সরিয়ে ভুয়া রহিমা খাতুনের ছবি ব্যবহার করা হয় নিবন্ধনের ক্ষেত্রে। গুরুতর এ জালিয়াতির ঘটনায় মানিকগঞ্জ সদরের তৎকালীন সাব-রেজিস্ট্রার মহসিন মিয়া, পিয়ন বিল্লাল হোসেন এবং অবসরপ্রাপ্ত টিসি মোহরার গুরুদাস পালের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ (ডিআর নং-৬৯২/) এনে জেলা রেজিস্ট্রারের কাছে প্রতিকার দাবি করেন রহিমা খাতুন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, শুধু আইনগত ব্যবস্থা নিলেই জমি-সংক্রান্ত জটিলতার অবসান হবে না। প্রয়োজন জমির নিবন্ধন এবং ভূমি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন। ডিজিটালাইজ করা এখন সময়ের দাবি। এটি যেমন সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন জাল-জালিয়াতি, দুর্নীতি রোধ এবং মানুষের হয়রানি লাঘবে।
তিনি বলেন, বিচারাধীন মামলার অধিকাংশই জমিজমা-সংক্রান্ত মামলা। যেখান থেকে এসব মামলার উৎপত্তি সেই জায়গাটিতে ব্লক দিতে না পারলে দেওয়ানি মামলার ক্রমঃবৃদ্ধি ঠেকানো যাবে না। এটি একটি জাতীয় সমস্যা। শুধু ভূমি সংক্রান্ত বিশাল বিশাল ভবন তৈরি করলেই হবে না। ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিস, তহসিল অফিস, এসি (ল্যান্ড) অফিস, ভূমি জরিপ ও রেকর্ড সংরক্ষণকে আধুনিক পদ্ধতির আওতায় নিয়ে আসা। এটি করা গেলে ভূমি বিরোধ বহুলাংশে হ্রাস পাবে। আদালতের ওপর থেকে মামলার চাপও কমবে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান যে, বাংলাদেশে ভূমি দলিল নিবন্ধন সেবা খাতে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। তিনি বলেন, ভূমি নিবন্ধন অফিসে প্রয়োজনীয় জনবল নেই, তাদের প্রশিক্ষণ নেই, আইনি কাঠামোতে ঘাটতি আছে এমন আরও অনেক সমস্যা আছে। তবে সবচেয়ে বড় অনিয়ম হয় সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে নিয়ম-বহির্ভূতভাবে কর্মকর্তারা অর্থ নিয়ে থাকেন।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, আইন মন্ত্রণালয়ের আওতায় নিবন্ধন অধিদপ্তরের অধীনে দেশের সকল জেলা ও উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস। এই অফিসগুলোতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের অসততা, দালালদের দৌরাত্ম্য আর দলির লিখার কাজে নিয়োজিত মহরারা রাজস্ব ফাকির পেছনে মূল দায়ী।
তিনি বলেন, একজন সাব-রেজিস্ট্রার জেনে বুঝেও আইন লংঘন করে দলিল নিবন্ধন করে দিচ্ছেন প্রকৃত মূল্য বা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও কম দাম দেখিয়ে। এখানেই মূল রহস্যটা। তাদেরকে জাবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্টরা সব কিছু জেনে বুঝে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি আলোচনায় আসছে না।